রাত গভীর, আকাশজুড়ে চাঁদের মৃদু আলো ছড়িয়ে আছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু জানালার পর্দা বাতাসে দোল খাচ্ছে। ইফতেখার আনমনে বসে আছে, হাতে একটা পুরনো চিঠি। চিঠির কালি কিছুটা ঝাপসা, হয়তো চোখের জলেই মিশে গেছে কোনো একদিন।
চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন ওর হৃদয়ের গভীরে পাথরের মতো গেঁথে আছে—
"তোমায় ভালোবাসা যদি ইবাদত হতো, তবে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেক-কার মানুষটি হতাম আমি।
তোমারে ভালোবাসা যদি পাপের কাজ হয়ে থাকে, তবে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পাপিষ্ঠ ব্যক্তিটিও আমি।"
ইফতেখারের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। রাফিয়া… ওর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতির নাম। কিন্তু সে-ই সবচেয়ে দুঃখের স্মৃতিও।
ছয় বছর আগের কথা। ইফতেখার আর রাফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ছিল। ওদের বন্ধুত্বের শুরুটা ছিল পড়াশোনার মধ্য দিয়ে, তারপর ধীরে ধীরে ভালোবাসার রং লাগতে শুরু করল। রাফিয়া ছিল স্নিগ্ধ, নরম হৃদয়ের মেয়ে। ইফতেখারের স্বপ্ন ছিল একদিন ওর হাত ধরে চিরদিনের জন্য একসঙ্গে পথ চলবে। কিন্তু বাস্তবতা সবসময় স্বপ্নের মতো হয় না।
রাফিয়ার পরিবার ছিল কঠোর, কঠিন নিয়মের বেড়াজালে বন্দি। তাদের কাছে ভালোবাসা মানে ছিল না, ছিল কেবল পারিবারিক সিদ্ধান্ত আর বংশের মান-সম্মান। তাই যখন ইফতেখার ওর ভালোবাসার কথা জানাল, তখনই বাধার দেয়াল উঠে দাঁড়াল।
রাফিয়া কাঁদতে কাঁদতে একদিন বলেছিল,
"একজন নেক-কার ব্যক্তিও মন থেকে এতটা ইবাদত করে না, যতটা মন থেকে আমি তোমারে ভালোবাসি। আর একজন পাপিষ্ঠ ব্যক্তিও এতটা পাপ কাজে লিপ্ত হয় না, যতটা লিপ্ত আমি তোমার ভালোবাসায় হয়েছি।"
কিন্তু সে ভালোবাসা কোনো দিন পূর্ণতা পেল না। পরিবার তাদের আলাদা করে দিল। রাফিয়াকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হলো দূরের এক শহরে। ইফতেখার অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সব বৃথা।
আজ এত বছর পর, রাফিয়ার কোনো খোঁজ নেই। ও কেমন আছে, সুখে আছে কি না, জানে না ইফতেখার। শুধু এই চিঠিটা পড়ে ওর বুকের ভেতর পুরনো ভালোবাসাটা আবার জ্বলে ওঠে।
চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে ইফতেখারের চোখে পড়ে। সে একবার আকাশের দিকে তাকায়। বুকের গভীর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
হয়তো ভালোবাসা সত্যিই ইবাদত, হয়তো এটি পাপ—কিন্তু একবার যাকে হৃদয় সত্যিকারের ভালোবাসে, সে ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না… শুধুই থেকে যায় সময়ের অতল গহ্বরে।